IQNA

মিয়ানমারে সাংবাদিকের মনে প্রশ্ন: কোভিডে মরব, না রাজনৈতিক সংকটে?

17:20 - August 02, 2021
সংবাদ: 3470433
তেহরান (ইকনা): এক সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জুটেছে মহামারীর খাঁড়া, কেড়ে নিয়েছে হাজারো প্রাণ- দুই সংকটে নাজেহাল মিয়ানমার যেন শ্বাস ফেলার জায়গা পাচ্ছে না।

মিয়ানমারে সাংবাদিকের মনে প্রশ্ন: কোভিডে মরব, না রাজনৈতিক সংকটে?বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারজুড়ে। বিপর্যয়ের মুখে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে, যার প্রতিবাদে ধারাবাহিক বিক্ষোভ চালিয়ে আসছিল জান্তাবিরোধীরা।

এই বিক্ষোভ ও অসহযোগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সেদেশের কয়েক হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীও রয়েছেন।

তাদের ওই আন্দোলনে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে মিয়ানমারের কোভিড-১৯ পরীক্ষা এবং টিকাদান কার্যক্রম। তার মধ্যে এখন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে ডেল্টা ধরনের বিস্তার।

সাধারণ মানুষ অক্সিজেন উৎপাদন কারখানার সামলে লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকছে সিলিন্ডার কেনা বা সেটা আবার ভরার আশায়, যদিও সরাসরি জনগণের কাছে অক্সিজেন বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সামরিক জান্তা। এত বেশি মৃতদেহ আসছে যে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার জায়গা দিতে পারছে না সমাধিক্ষেত্রগুলো।

বিবিসি লিখেছে, মিয়ানমারের অনেকের কাছেই এ পরিস্থিতি এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত, যার ওপারে কোনো আলোর দেখা নেই।

সাংবাদিক আয়ে মিয়া (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, “নিজেদেরকেই ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছি, আমরা কি কোভিডে মারা যাব? না রাজনৈতিক সংকটের বলি হয়ে প্রাণ হারাব? এটা অনেকটা যেনো মৃত্যুর একটি ভালো উপায় বেছে নেওয়ার মত।”

মিয়ানমারের সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিতের সংখ্যা ২ লাখ ৮০ হাজার এবং মারা গেছেন ৮ হাজার ২০০ জন। যদিও ধারণা করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি, কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার সুযোগ সেখানে সীমিত।

৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এই দেশে জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে মাত্র ৯ থেকে ১৭ হাজার নাগরিকের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।


মৃত্যুর সংখ্যাও সরকারি হিসাবে অনেক কম আসছে, কারণ যারা হাসপাতালে মারা যাচ্ছেন, শুধু তাদের তথ্যই সরকারি হিসাবে জায়গা পাচ্ছে।


আয়ে মিয়া বিশ্বাস করেন, তার মায়ের মৃত্যু সরকারি গণনায় আসেনি, কারণ তার কোভিড পরীক্ষা করা হয়নি, যদিও তিনি এই রোগের উপসর্গ নিয়েই মারা গেছেন। আয়ে মিয়ার আশঙ্কা, তার কাছ থেকেই তার মা সংক্রমিত হয়েছিলেন।

অবশ্য মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নিজে কোভিড পরীক্ষা করিয়েছিলেন, কিন্তু তখন সংক্রমণ ছিল না। তবে আয়ে মিয়ার ধারণা, তিনি যখন চার মাস কারাগারে বন্দি ছিলেন, তখনই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন।

অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পরপরই তার কোভিড উপসর্গ দেখা দেয়।
তিনি বলেন, “কারাগারে একই কক্ষে আমাদের ৫০ জনকে রাখা হয়েছিল। খুবই গাদাগাদি অবস্থা। আমার চারপাশে কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ রোগীও দেখেছি।

“আমি যখন কারাগার থেকে বের হয়ে আসি, তখন আমার মা সুস্থ ছিলেন, তিনি আমার চুল ধুয়ে দিয়েছেন এবং আমরা একসঙ্গে খেয়েছি। কিন্তু আমার অসুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর তিনিও অসুস্থ হলেন। আমি কয়েকদিন পর সুস্থ হলেও তার অবস্থা খারাপের দিকে গেল। তিনি খেতে পারতেন না, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।”

মায়ের কষ্টদায়ক মৃত্যুর অভিজ্ঞতা স্মরণ করে এই সাংবাদিক বলেন, “মাঝেমাঝেই আমার মনে হয়, আমদের ওপর জীবাণু অস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়েছে।

“যখন আমরা হাসপাতালে গেলাম, তারা জানালো যে সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই। আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহের চেষ্টা করতে লাগলাম। আশপাশের লোকেদের জিজ্ঞেস করলাম কোথাও অল্প সময়ের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়া সম্ভব কিনা। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। যখন আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজছিলাম, তখনই আমার মায়ের মৃত্যু হয়।”

মিয়ানমারে এখন সবচেয়ে মূল্যবান পণ্যে পরিণত হয়েছে অক্সিজেন। অবশ্য সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লায়িং ঘাটতির কথা নাকচ করে বলেছেন, ‘উদ্বেগ’ থেকে দেশের মানুষ অক্সিজেন মজুদ করছে।

‘মজুদদারি’ ঠেকাতে ব্যক্তি পর্যায়ে অক্সিজেন বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে সামরিক বাহিনী। তবে কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন, সেনাবাহিনী বেশিরভাগ অক্সিজেন সামরিক হাসপাতালগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে।

একটি এনজিওতে কর্মরত একজন চিকিৎসক বিবিসিকে বলেছেন, “আমাদের যে বন্ধুরা এখনও সরকারি হাসপাতালে কাজ করছে, তাদের কাছেই শুনেছি, সেনাবাহিনীর লোকজন এসে হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গেছে।”

ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা

মিয়ানমারের চিকিৎসা ব্যবস্থা সবসময়ই ছিল ভঙ্গুর দশায়। সম্পদের সীমাবদ্ধতার পরও গত বছর দেশটি করোনাভাইরাসের প্রকোপ সামলে নিতে পেরেছিল। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান সেই পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে।

ইয়াংগনের গবেষণা সংস্থা টাম্পাদিপার পরিচালক খিন জ বলেন, “[মহামারীর জন্য] আমরা ভালোভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। তারওপর সেনাবাহিনী এই সময়টা বেছে নিল অভ্যুত্থানের জন্য। নিজের দেশের মানুষের প্রাণের প্রতি তাদের এই অবহেলা সত্যি স্তম্ভিত করার মত।”

ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ফিউ ফিউ থিন জ বলেন, “অন্য দেশ সংক্রমণের গ্রাফ সরলরেখায় নামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, যাতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে। কিন্তু মিয়ানমারে এই সামরিক অভ্যুত্থান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ে ফেলে দিয়েছে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানার আগেই।”

অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে সবচেয়ে আগে যারা ধর্মঘটে নেমেছে, তাদের মধ্যে চিকিৎসা কর্মীরাও আছে। তাদের মধ্যে টিকাদান কর্মসূচির সাবেক প্রধানসহ ৭২ জন এখন কারাবন্দি। আরও ৬০০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস।

বেসামরিক অসযোগ অন্দোলনের অংশ হিসেবে যেসব জায়গায় চিকিৎসক ও নার্সরা বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন, সেসব স্থাপনাও হুমকির মুখে রয়েছে।

বাড়িতে কোভিড রোগী দেখতে যাওয়ার অনুরোধের ছলে সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তবে সেনাবাহিনী সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

সামরিক বাহিনীর দাবি, প্রায় ৬০ শতাংশ চিকিৎসাকর্মী এখনও কাজ করছেন- যদিও এই সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমারে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রমও বিঘ্নিত হচ্ছে। অভ্যুত্থানের ঠিক ৫ দিন আগে বেসামরিক সরকার টিকাদানের কাজটি শুরু করেছিল।

সামরিক জান্তার কাছে এখন চীনের তৈরি ৬০ লাখ ডোজ টিকা আছে; আর রাশিয়া থেকে ২০ লাখ ডোজ শিগগিরই পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

খিন জ উইনের মতে, টিকার চালান পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া সামরিক বাহিনী কীভাবে জনগণকে টিকা নিতে উৎসাহিত করবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে তার।

পরিস্থিতির অবনতির চিত্রটি স্পষ্ট দৃশ্যমান ইয়াংগনের সমাধিক্ষেত্রে, যেখানে প্রতিদিন শবদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আর গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে।

ইয়াংগনের বো সেইন ফিউনারেল সার্ভিসের সেইন উইন থাই বলেন, এত মরদেহ সামাল দিতে পারছেন না তিনি।

“আমার নিজের বাবাই তিন দিন আগে মারা গেছেন। সকাল ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। অথচ তার জন্য দ্রুত একটি গাড়ির ব্যবস্থাও করতে পারিনি। অথচ আমি নিজেই একটা অন্তোষ্ট্যিক্রিয়া সেবার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি।
“[শেষ পর্যন্ত] যখন আমরা ইয়েই ওয়ে সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছলাম, আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে, কারণ আগে থেকে অনেকের মরদেহ অপেক্ষায় ছিল, তাদের সবাই কোভিডে মারা গেছেন।”

ইয়াংগন রিজিওন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের প্রধান হ্লা সোয়ে জানান, ১৯ জুলাই দেড় হাজার মরদেহের তথ্য নথিভুক্ত করেছেন তারা, যা সেদিন কোভিডে মৃতের সরকারি সংখ্যা ২৮১ জনের চেয়ে অনেক বেশি।

তিনি জানান, ইয়াংগনের সমাধিক্ষেত্রগুলো একদিনে সর্বোচ্চ ৩০০ মরদেহের ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম।

বিবিসি লিখেছে, সাংবাদিক অয়ে মিয়ার পরিবার অবশেষে একটি ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে পেরেছে, যদিও তা এখন আর তার মায়ের কোনো কাজে লাগবে না। তবে এখন তাদের পরিবারের আরও তিনজনের কোভিড শনাক্ত হয়েছে।

অয়ে মিয়া বলেন, “বাবা যখন অক্সিজেন সিলিন্ডারটা দেখেন, কি যে কষ্ট পান, তার শুধু মনে হয়, আমরা মাকে বাঁচাতে পারলাম না শুধু সময়মতো এটা জোগাড় করতে পারিনি বলে।

“এখন আমাদের একে অন্যকে দেখে রাখতে হবে; আমরা পরিবারের আর কাউকে হারাতে চাই না।” বিডি নিউজ

captcha