IQNA

ইসলামের মহা-নক্ষত্র ইমাম বাক্বির (আ)'র শাহাদাত

18:16 - July 17, 2021
সংবাদ: 3470330
তেহরান (ইকনা): ১১৪ হিজরির ৭ জিলহজ্ব ইসলামের ইতিহাসের এক মহাশোকের দিন। কারণ, এই দিনে শাহাদাত বরণ করেছিলেন বিশ্বনবীর (সা.)’ পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য তথা তাঁর নাতির নাতি (প্র-প্রপৌত্র) হযরত ইমাম বাক্বির (আ.)। মহানবীর আহলে-বাইত ছিলেন হেদায়াতরূপ খোদায়ী নূরের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ও মানবীয় পরিপূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শ।

তাঁরা ছিলেন খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের সংরক্ষক, ক্রম-বিকাশক এবং পূর্ণতার মাধ্যম। ইমাম মুহাম্মাদ বাক্বির (আ.) ও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর জন্ম হয়েছিল পবিত্র মদিনায় ৫৭ হিজরির পয়লা রজব অথবা তেসরা সফর। তাঁর মা ছিলেন ইমাম হাসানের কন্যা ফাতিমা (সা.আ)। কারবালার মহা-ট্র্যাজেডি ও মহা-বিপ্লবের সময় তিনি পিতা ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও দাদা ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর। পিতা ইমাম জাইনুল আবেদিন (আ.) হিজরি ৯৫ সালে শাহাদত বরণ করলে তিনি মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব তথা ইমামত লাভ করেন। সেই থেকে শাহাদাতের সময় তথা ১৯ বছর পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

মহানবী (সা) তাঁর সাহাবি হযরত জাবেরকে বলেছিলেন যে ‘তুমি আমার বংশধর বাক্বিরকে দেখতে পাবে, তাঁর নামও হবে মুহাম্মাদ এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যও হবে আমার মত। সে হবে জ্ঞান-বিদারক বা উন্মোচক তথা বাক্বির। তুমি তাঁর কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও।’ জাবের (রা.) সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই মহান ইমামের পবিত্র শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং এই মহান ইমামের শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম।

ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ এ ধর্মের সার্বিক দিকগুলোর সংরক্ষণ ও ক্রম-বিকাশে রয়েছে ইমাম বাক্বির (আ.)’র অনন্য অবদান। তাঁর আগে মহানবীর (সা) বংশধারার নিষ্পাপ সদস্যরা সত্যকে তুলে ধরার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকায় এবং সমর্থকদের নিরাপত্তা না থাকায় ইসলামী সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিস্তার আন্দোলনের কোনও প্রকাশ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে যেতে পারেননি। কিন্তু এই কাজ প্রকাশ্যেই ও মোটামুটি বিনা বাধায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন ইমাম বাক্বির (আ)। আর এ জনই তাঁকে বাক্বির আল উলুম বা জ্ঞান বিদীর্ণকারী বলা হয় যা তাঁর সবচেয়ে বড় উপাধি।


ইমাম বাক্বির (আ) প্রকাশ্যেই ছাত্র ও সমর্থকদের সমাবেশে ইসলামী বিশ্বাস ও কুরআন-হাদিস সম্পর্কে বক্তব্য রেখে, জ্ঞানগত বহু বিতর্কে অংশ নিয়ে এবং তাঁর আলোচনাগুলোর সংকলন প্রকাশের অনুমতি দিয়ে ইসলামী জ্ঞান-আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছিলেন। ইমাম বাক্বির (আ)’র দাদা ছিলেন সর্বোচ্চ ত্যাগ ও কোরবানির মাধ্যমে খাঁটি ইসলামকে টিকিয়ে রাখার অনন্য আদর্শের প্রতীক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) এবং নানা ছিলেন ইসলামকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরও এক পরিপূর্ণ আদর্শের স্রস্টা হযরত ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)। প্রকাশ্যেই ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরাসহ ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার যে কাজ ইমাম বাক্বির (আ.)’র মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল তাকে ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ ও ফলপ্রসূ করেছিলেন তাঁরই পুত্র হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.)। ধর্ম ও বিজ্ঞানসহ সব বিষয়ে বাক্বির (আ.)’র প্রজ্ঞা আর অলৌকিক জ্ঞান এবং সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্র ও আত্মিক গুণগুলোর পাশাপাশি সব ধরনের মানবীয় যোগ্যতার ক্ষেত্রেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। বিশ্বনবী (সা.)’র সুন্নাতের অনুসরণ, সততা ও ইবাদত-সাধনায়ও তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ আদর্শ।

ইসলামকে বোঝা ও অনুসরণের জন্য জ্ঞান-চর্চার গুরুত্ব তুলে ধরে ইমাম বাক্বির (আ.) বলেছেন, একজন জ্ঞানী বা আলেমের জ্ঞান যদি মানুষের কল্যাণে আসে তবে সেই জ্ঞানী সত্তুর জন আবেদ বা দরবেশের চেয়েও উত্তম’। ইমাম বাক্বির (আ) ছিলেন দ্বীন ও দুনিয়ার জ্ঞানের বিকাশকারী এবং বিশ্লেষক। আল্লাহ-প্রদত্ত অলৌকিক জ্ঞানের অধিকারী ইমামের জ্ঞানের কাছে সে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীরাও ছিলেন শিশুর মত তুচ্ছ। পিতা ইমাম জাইনুল আবেদিন (আ) ও তাঁর পুত্র ইমাম বাক্বিরের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)’র সুন্নাহ’র জ্ঞান ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে।


ইমাম বাক্বির (আ.) নানা বিষয়ে জ্ঞান-অন্বেষণকারীদের অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান দিতেন। ইমাম বাক্বির (আ.) ও তাঁর পুত্র ইমাম জাফর সাদিক্ব (আ.)’র সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে তাঁদের ছাত্ররা মুসলিম সমাজকে উপহার দিয়েছিলেন প্রায় ছয় হাজার বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ।

ইমাম বাক্বির (আ)’র কয়েকটি বইয়ের কথা জানা যায়। তাঁর একটি বইয়ের নাম ‘মাআসিরুল বাক্বির। এ বইয়ে আত্মার বৈশিষ্ট্য, আলেমদের বৈশিষ্ট্য ও মহান আল্লাহর নানা গুণ এবং তাঁর খোদায়ী সত্ত্বার বিষয়সহ বহু বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। তাঁর আরেকটি বইয়ের নাম উম্মুল কিতাব। এতে রয়েছে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক নানা প্রতীকের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত আলোচনা। এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা বিষয়ে ইমামের একটি সংকলনও রয়েছে যার নাম ‘তাফসির আল বাক্বির’।

ইমাম বাক্বির (আ) ছিলেন শ্রেষ্ঠ আবেদ ও পরহিজগার এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও শ্রেষ্ঠ নেতা, আইনবিদ ও সংস্কারক। তিনি নামাজে আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতেন যেন তিনি সরাসরি আল্লাহকে দেখছেন। পরহিজগারদের আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কঠোর কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতেন। কোনও সাহায্য প্রার্থী বা অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি কখনও ইমাম বাক্বির (আ.)’র কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরেনি।

জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল অন্যান্য ইমামদের মতই ইমাম বাক্বির (আ.)’র চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি বনি উমাইয়া শাসকদের নানা কুকীর্তির সমালোচনা করতেন। ফলে উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আবদুল মালিক তাঁকে সিরিয়ায় নিজ দরবারে তলব করে। ইমাম বাক্বির আ. সেখানে উপস্থিতি হয়ে বলেছিলেন: ‘তোমার হাতে রয়েছে ক্ষণস্থায়ী রাজত্ব, কিন্তু আমাদের জন্যই হল চিরস্থায়ী নেতৃত্ব ও শাসন এবং খোদা-ভীরুদের জন্যই রয়েছে শুভ-পরিণাম।’ সিরিয়ায় ইমাম বাক্বির (আ.)’র উপস্থিতি তাঁর আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বকে সবার কাছেই স্পষ্ট করে দেয়। সেখানেও তিনি খাঁটি ইসলামকে স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেন। ফলে গণ-জাগরণের ভয়ে ভীত হিশাম ইমামকে আবারও মদিনায় ফেরত পাঠায়। হিশাম ইমাম বাকির (আ)’র জ্ঞানগত যোগ্যতার কাছে আহাম্মকতুল্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। বিতর্কে পরাজিত হয়ে হিশাম ক্রুদ্ধ হয়ে ৫৭ বছর বয়স্ক ইমাম বাকের (আ.) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করে। সেই শোকাবহ দিনটিই হলো ৭ জিলহজ্ব। মদিনায় পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে পিতা ইমাম জাইনুল আবেদিনের কবরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।

হিশামের হিংসা ইমাম বাক্বিরকে শহীদ করলেও তা নেভাতে পারেনি ইমামের রেখে যাওয়া জ্ঞানের আলো এবং মুসলিম মানসে আহলে বাইতের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রদীপ্ত শিখা। আর সেই আলো ধরেই আজো ইসলামী ইরানসহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে এগিয়ে চলছে মানবজাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী সভ্যতা পুনর্নির্মাণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। ইমাম বাক্বির (আ.) সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে বলেন: নিঃসন্দেহে যাদের মাঝে তিনটি গুণের সমাবেশ নেই তারা নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য নয়। ঐ তিনটি গুণ হলো-এক: আল্লাহকে ভয় করা ও খোদার নাফরমানী থেকে নিরাপদ থাকা, দুইঃ সহিষ্ণুতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা এবং তিনঃ অধীনস্থদের ব্যাপারে পিতৃসুলভ সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা। পার্সটুডে

captcha