আলী (আ.) সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম ও ন্যায়-বিচার কায়েমের তথা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলেই সুবিধাবাদী, মুনাফিক এবং স্বল্প-জ্ঞানী ধর্মান্ধ ও বিভ্রান্ত শ্রেণীগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন, তিনি খিলাফত লাভের পর সব সাহাবির জন্য সরকার-প্রদত্ত ভাতা সমান করে দিয়ে রাসূল (সা.) সুন্নাত পুন:প্রবর্তন করেছিলেন। ফলে অনেকেই তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়।
হযরত আলী (আ.) জানতেন সত্যের পথে অবিচল থাকলে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও নেতা তাঁকে ত্যাগ করবেন বলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়-বিচারের পথ ত্যাগ করেননি। ফলে শাহাদতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন হযরত আলী (আ.)। মুয়াবিয়া যখন বায়তুল মালের সম্পদ অবাধে ব্যবহার করে নিজের পক্ষে সুযোগ সন্ধানী লোকদের টেনে দল ভারী করতো, তখন মুয়াবিয়ার বিদ্রোহের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও হযরত আলী (আঃ) তাঁর গভর্নরদের মাধ্যমে ব্যবহৃত বায়তুল মালের সম্পদের প্রতিটি পয়সার হিসেব নিতেন।
উল্লেখ্য, মুয়াবিয়ার বাবা আবু সুফিয়ান ছিল ইসলামের ও বিশ্বনবী (সা.)’র কঠোরতম শত্রু । মক্কা বিজয়ের পর (অষ্টম হিজরিতে) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর সঙ্গে তার শত্রুতা অব্যাহত থাকে। হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে এক মিথ্যা অজুহাতে সে সিরিয়া থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এই বিদ্রোহের কারণে। এই যুদ্ধে মুয়াবিয়ার পক্ষে ৪৫ হাজার নিহত এবং হযরত আলী (আ.)’র পক্ষে শহীদ হন পঁচিশ হাজার মুজাহিদ।
হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বিদ্রোহ শুরু করার পেছনে মুয়াবিয়ার অজুহাত ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডের বিচার। এটা যে নিছক অজুহাতই ছিল তার প্রমাণ হল হযরত আলী (আ.)’র শাহাদতের পর মুসলিম বিশ্বের সব অঞ্চল ছলে বলে কৌশলে করায়ত্ত করা সত্ত্বেও মুয়াবিয়া আর কখনও তৃতীয় খলিফার হত্যাকারীদের বিচারের কথা মুখেও উচ্চারণ করেনি। দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল থেকেই সিরিয়ায় প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রধানের মত চালচলনে অভ্যস্ত মুয়াবিয়া জানত যে হযরত আলী (আ.)’র মত কঠোর ন্যায়-বিচারক শাসক তাকে কখনও ছোট বা বড় কোন পদ দেবেন না। তাই আলী (আ.) খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মত মুয়াবিয়াকেও পদচ্যুত করলে ইসলামের ইতিহাসে রাজতন্ত্র প্রবর্তনকারী মুয়াবিয়া সিরিয়ায় বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে।
মুয়াবিয়া সিরিয়াতে বহু বছর ধরে গভর্নর ছিল। সেখানে আলী (আ.) ও তাঁর পরিবার এবং বংশধরদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কুতসা রটনা ও গালি দেয়ার প্রচলন শুরু করেছিল মুয়াবিয়া। এই নোংরা প্রথাটি বন্ধ করেছিল ইতিহাস-খ্যাত দ্বিতীয় ওমর। বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত ও আলী-পরিবারের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচারণার প্রভাবে সিরিয়ার জনগণ এতটাই বিভ্রান্ত হয়েছিল যে, আলী (আ.) কুফার মসজিদে শহীদ হয়েছেন শুনে দামেস্কের অনেকেই প্রশ্ন করেছিল: আলী মসজিদে মারা গেল কিভাবে! সে কি নামাজ পড়ত?!
বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়:
...মুসলিম তোরা কাঁদ্।..
... ...
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।.....
বিশ্বনবী (সা.) তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীতে বলেছিলেন, আমার পরে তোমারা নাকিতুন, কাসিতুন ও মারিকুনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। খারেজীদের দেখা পেলে রাসূল-সাঃ তাদের ধ্বংস করে দিতেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। যারা জামাল যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)'র বিপক্ষে লড়াই করেছিল আলী (আঃ) তাদেরকে নাকিতুন বা আনুগত্য ভঙ্গকারী, সিফফিনের যুদ্ধে বিপক্ষীয়দেরকে তিনি কাসিতুন বা বিপথগামী এবং নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বিপক্ষীয় খারেজীদেরকে তিনি মারিকুন বা ধর্মের সত্য উপলব্ধিতে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
একবার শাবান মাসের শেষ শুক্রবারে মদীনার মসজিদে রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান করার এক পর্যায়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কেঁদে ফেললেন। হযরত আলী (আঃ) প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কেন কাঁদলেন? উত্তরে তিনি বললেন, এ মাসে তোমার ওপর যে মুসিবত বা কষ্ট হবে তা মনে করছি। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, তুমি আল্লাহর দরবারে নামাজ পড়ছো এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকটি তোমার মাথায় কয়েকটি আঘাত হানছে ও এরফলে তোমার দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে! আলী (আঃ) প্রশ্ন করলেন, সে সময় কি আমার ঈমান অটুট থাকবে? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ।
৪০ হিজরির ১৯ শে রমজানে যখন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষটি সিজদারত আলী (আ.) মাথায় বিষ-মাখানো তরবারির আঘাত হানে তখনই তিনি বলে ওঠেন, কাবার প্রভুর শপথ, আমি সফল! ২১ রমজানের রাতে শাহাদতের কিছুক্ষণ আগেও তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! শাহাদত আমার কাছে এমন কিছু নয় যে তার সম্মুখীন হতে আমি অসন্তুষ্ট হব, বরং তা যেন আমার কাছে নিজের হারানো অস্তিত্বকে ফিরে পাবার মত আনন্দদায়ক, কিংবা আমি যেন রাতের অন্ধকারে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি খুঁজছিলাম, আর হঠাৎ তা পেয়ে গেলাম, আল্লাহর কাছে যা আছে সৎকর্মশীলদের জন্য সেটাই তো উত্তম। # পার্সটুডে